নিউজিল্যান্ডের স্ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে মুসলিমদেরকে হত্যা ।
এই হলো সেই অস্ত্র, যেটি ব্যবহার করে নিউজিল্যান্ডের স্ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হয়েছে। উগ্র খ্রিষ্টীয় চরমপন্থা, অনেক তারিখ এবং ইতিহাসের পাতা থেকে কতগুলো নাম সমগ্র অস্ত্রটিতে লেখা রয়েছে। এই লেখাগুলো আসলে কী বুঝাচ্ছে?
চলুন, দেখে নিই!
১। Charles Martel- চার্লস মার্টেল
চার্লস মার্টেল ফ্রান্সিয়ার (বর্তমানে ফ্রান্স) রাজা ছিল । সে ইউরোপীয় ইতিহাসে এক বিশেষ কারণে পরিচিত! সে ছিল ঐ ব্যক্তি যে ৭৩২খ্রিষ্টাব্দে তুরের যুদ্ধে পশ্চিম ইউরোপে ইসলামী খেলাফতের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল। এই কারণেই তাকে উগ্র খ্রিষ্টীয় শিক্ষায় বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় এবং তাকে সম্মান করা হয়।
২। Tours 732- তুর ৭৩২
তুরের যুদ্ধ ৭৩২ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের তুর ও পোয়াতিয়ে শহরের কাছে ফ্রাংক ও বুর্গুন্দীয় সেনাদের সাথে উমাইয়াহ খিলাফতের সেনাদের যুদ্ধ। যুদ্ধে ফ্রাংকরা জয়লাভ করে এবং এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে মুসলিমদের অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়। এটি ছিল এক অর্থে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রের বেশ কাছে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। অনেক ইতিহাসবিদ এই যুদ্ধের ফলাফলকে ইউরোপের খ্রিস্টানদের জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। তাদের মতে এই যুদ্ধে খ্রিস্টানরা পরাজিত হলে গোটা ইউরোপের ইসলামীকরণের সম্ভাবনা ছিল এবং তা হলে ইউরোপের ইতিহাসই পালটে যেত।
প্রাথমিকভাবে যুদ্ধে মুসলিমরা ভালো অবস্থানে ছিল, খেলাফতের সৈনিকেরা বিজয়ের প্রায় কাছাকাছি ছিল। কিন্তু, এরপরই খেলাফতের সৈনিকেরা যুদ্ধের ময়দানে গণিমতের মাল পড়ে থাকতে দেখে নিজেদের লোভ সামলাতে পারেননি। কমান্ডার আব্দুর রহমান আল-গাফিকির নির্দেশ অমান্য করে গণিমত সংগ্রহ করতে নিজেদের সারিসমূহ ভেঙ্গে ফেলেন। এই অবস্থা দেখে খ্রিষ্টান বাহিনী নতুনভাবে উজ্জীবিত হয় এবং মুসলিমদের উপর আঘাত হানে। এ সময় অধিকাংশ মুসলিমই নিরস্ত্র ছিলেন, যেহেতু অস্ত্র রেখে দিয়ে তারা যত বেশি পারেন সম্পদ সংগ্রহে মগ্ন ছিলেন। দুঃখজনকভাবে, খেলাফতের সৈনিকেরা ময়দান ছেড়ে পলায়ন করেন, কিন্তু বীর আব্দুর রহমান আল-গাফিকি একাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান। ফ্রাংকদের বিরুদ্ধে এক বীরত্বপূর্ণ আঘাত হানেন এবং শাহাদাতবরণ করেন।
৩। Vienna 1683- ভিয়েনা ১৬৮৩
১৬৮৩সালে পরিচালিত ভিয়েনার যুদ্ধ ছিল ইতিহাসে ইসলামী খেলাফতের সর্বশেষ আক্রমণাত্মক জিহাদ। ১৬শ শতাব্দীতে উসমানীয় খেলাফত ছিল বিশ্বের সুপারপাওয়ার। এর বিশাল আকারের সেনাবাহিনী ছিল। উসমানী খেলাফতের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে তারা সহজেই ইউরোপ বিজয় করছিলেন। পোপ অনেক যোদ্ধা তৈরি করেছিলেন এবং অনেক খ্রিষ্টানের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলেছিলেন যেন উসমানী খেলাফতের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেন। তবে, সমগ্র ইউরোপ একত্রিত হয়েও উসমানী খেলাফতের উত্থানকে থামাতে পারছিল না।
১৬৮৩সালে, উসমানী সেনাবাহিনী ভিয়েনা শহর অবরোধ করে, ঐ সময় শহরটি ‘ইউরোপের হৃদয়’ বলে পরিচিত ছিল। উসমানীদের ছিল ৩লাখ সৈন্যের বিশালাকারের এক বাহিনী। তবে, অবশেষে উসমানী কমান্ডার কারা মোস্তফার ঔদ্ধত্যতা এবং সুলতানের নির্দেশ অমান্য করার কারণে উসমানীরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। আর, কারা মোস্তফাকে সুলতান মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৬৮৩সালে ভিয়েনায় পরাজয়বরণ করা মুসলিম বিশ্বের জন্য বিপর্যয় ছিল। সেখান থেকে ইসলামী উম্মাহর অবনতি শুরু হয়। আর, তারপর আর কোন আক্রমণাত্মক যুদ্ধ অর্থাৎ ইসলামের বিস্তৃতি ঘটেনি। মুসলিমরা সবদিক থেকেই অবনতির শিকার হতে থাকে।
১৬৮৩ এমন এক বছর যখন মুসলিম উম্মাহ তাদের সুপারপাওয়ার হওয়ার মর্যাদা হারায়।
৪। Calivijo 844- ক্লাভিজু ৮৪৪
স্পেনিশ চার্চের সূত্র অনুসারে, ক্লাভিজুর যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের উপর খ্রিষ্টানদের মহা বিজয়! তবে যাইহোক, অধিকাংশ আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ঘোষণা করেছেন যে, এই ধরণের কোন যুদ্ধ হয়নি এবং মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে স্পেনের চার্চ এটাকে কাল্পনিক রূপ দিয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে এই যুদ্ধের কোন প্রমাণ নেই।
৫। Odo the great- ওডো দ্য গ্রেট
ওডো দ্য গ্রেট ছিল ৮ম শতাব্দীতে ফ্রাংকদের শাসক ছিল। সে ইউরোপে প্রথম খ্রিষ্টান রাজা হিসেবে পরিচিত যে ৭২১সালের যুদ্ধে উমাইয়্যা খেলাফতকে পরাজিত করে। যাইহোক, ৭৩২সালে গ্যারুন্নী নদীর যুদ্ধে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির হাতে অবমাননাকরভাবে পরাজিত হয় সে।
৬। Alexandre Bissonnette – আলেকজান্ডার বিসোনেট
আলেকজান্ডার বিসোনেট হলো ঐ সন্ত্রাসীর নাম, যে ২০১৭সালের ২৯শে জানুয়ারী কানাডার কুইবেক সিটি মসজিদে গুলি চালিয়েছিল। ঐ ঘটনায় ৬জন মুসলিম শহীদ (ইনশাআল্লাহ) হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন আরো ৮জন।
৭। skanderbeg- সেকান্দার বেগ
সেকান্দার বেগ (১৪০৫-১৪৬৮) নামেই পরিচিত। সে ছিল ১৫-শতকের একজন আলবেনীয় সামন্ত রাজা। উসমানীয় সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অন্যতম প্রধান খ্রিস্টান ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে সে উসমানী সাম্রাজ্যের হয়ে কাজ করতো, পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকতা করে উসমানী সালতানাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সে ছিল চরম ঔদ্ধত্য রক্তপিপাসু গেরিলা যোদ্ধা। সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অতি কঠোর ছিল। এমনকি তার নির্মমতা এবং অত্যাচারের জন্য খ্রিষ্টানরাও সুলতান মেহমেদ দুই এর কাছে অনুরোধ জানায়।
৮। Anton Lundin Pettersson- আন্তন লান্ডিন পেটারসন
আন্তন লান্ডিন পেটারসন হলো ঐ সন্ত্রাসী যে ২০১৫সালের ২২শে অক্টোবর সুইডেনের ট্রলহাটনের একটি স্কুলে হামলা চালায়। ২১ বছর বয়সী এই সন্ত্রাসী উগ্র খ্রিষ্টীয় শিক্ষায় দীক্ষিত হয়। পরবর্তীতে সেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি স্কুলে বাচ্চাদের উপর খোলা তলোয়ার নিয়ে হামলা চালায়।
৯। Marco Antonio Bragadin – মার্কু অ্যান্টোনিয়ো ব্রাগাদিন
মার্কু অ্যান্টোনিয়ো ব্রাগাদিন (২১শে এপ্রিল ১৫২৩-১৭ই আগস্ট ১৫৭১) ভেনিসের একজন সামরিক অফিসার ছিল। ১৫৬৯সালে সে সাইপ্রাস রাজ্যের ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং ফামাগোস্তায় চলে যায়। সেখান থেকে সে মুসলিমদের জাহাজ এবং হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদিনায় রওয়ানাকারী জাহাজের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল। বন্দী মুসলিমদের প্রতি সে ছিল নির্মম, মুসলিমদেরকে বন্দী করে নির্মমভাবে অত্যাচার করতো, নির্দয়তার সাথে হত্যা করতো।
১৫৭০সালে ১৭ই সেপ্টেম্বর, উসমানীয় নৌ বাহিনী শহরটিকে অবরোধ করেন এবং মুসলিমদের হাতে শহরটির পতন হয়। এরপর, মার্কু অ্যান্টোনিয়ো ব্রাগাদিনকে মুসলিমদের প্রতি তার নির্দয় অত্যাচারের কারণে উসমানীয়রা মৃত্যুদণ্ড দেন।
১০। Kebab- কেবাব
‘কেবাব’-এর আধুনিক পরিভাষা মুসলিমদেরকে অবমাননা করতে ব্যবহৃত হয়। যখন উসমানীয়রা কেবাব বিজয় করেছিলেন তখন থেকে খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলো এই শব্দটি দিয়ে উসমানীয়দের উদ্দেশ্য করতো।
১১। For Berlin, For Madrid- বার্লিনের জন্য, মাদ্রিদের জন্য
বার্লিন এবং মাদ্রিদ শহরে আইসিসের চালানো হামলাকে উদ্দেশ্য করছে।
সুতরাং, তার বন্দুকের লেখাগুলো থেকে বুঝা যায়, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে চালানো ঐ হামলাটি ছিল ধর্মীয়বিদ্বেষের জেরে। এটা হলো খ্রিষ্টীয় উগ্রপন্থার একটি নমুনা।
No comments